হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.) এর জীবন ছিল যেন রাসুলের (সা.) জীবনের প্রতিচ্ছবি। সব সময় তিনি চেষ্টা করতেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতিটি কাজ ও আচরণ হুবহু অনুসরণ করতে। রমজানের রোজা ছাড়াও তিনি নফল রোজা রাখতেন। এ ছাড়া তিনি আশুরার রোজা রাখতেন এবং মানুষকে তা রাখতে বলতেন। প্রচুর গরমের সময় ও তাঁকে রোজা রাখতে দেখা যেত। তিনি বলতেন হয়তো দুপুরের গরমের তৃষ্ণা কিয়ামতের দিনে আমাদের জন্য প্রশমিত হবে। সুন্নত ছাডা মুস্তাহাবের প্রতিও তিনি খুব যত্নবান ছিলেন। কোরবানির পশু নিজ হাতেউ জবাই করা মুস্তাহাব। এ কারণে তিনি তাঁর কন্যাদেরও হুকুম দিতেন নিজ হাতে পশু জবাই করার জন্য। আবু মুসা (রা.) জীবনের শেষ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আদেশ ও নিষেধ পালনে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তাঁর অবস্থা যখন সংকটজনক হয়ে পড়ে এবং তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন তখন নারীরা কান্নাকাটি শুরু করেন। সেই কঠিন মুহূর্তেও ক্ষণিকের জন্য চেতনা ফিরে পেলে তিনি বলেন রাসুল (সা.) এভাবে বিলাপ করতে নিষেধ করেছেন। আবু মুসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস আশ-আশয়ারী (রা.) যিনি আবু মুসা আল-আশয়ারি নামেই বেশি পরিচিত তনি রাসুলুল্লাহ (সা.) সহচর ছিলেন এবং ইসলামের প্রথম দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর বংশধারা হচ্ছে আবু মুসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস ইবনে সোলায়মান ইবনে হাদ্দার ইবনে আশয়ার। তিনি পবিত্র মক্কায় রাসূল (স.) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কায় প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে আবু মুসা আশয়ারী (রা.) অন্যতম। হজরত আবূ মূসা আল-আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস পাওয়া গেছে ৭৮১ টি। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বেশ কয়েকজন কুরআন সাধক ও বিখ্যাত ক্বারি ছিলেন। যাদের কুরআন তেলাওয়াত ও তালিম ছিল অসাধারণ। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু। সুমিষ্ট কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতকারী হিসেবে পুরো মদিনা জুড়ে ছিল তার সুখ্যাতি।
হজরত আবু মুসা (রা.) এর মধ্যে এ গুণ পরিপূর্ণরূপে ছিল। রাতে ঘুমানোর সময়ও তিনি বিশেষ ধরনের পোশাক পরে নিতেন যাতে সতর (শরীরের সেসব অংশ অপরের সামনে ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক) উন্মুক্ত না হয়ে যায়। আবু মুসা (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে প্রকৃতির। প্রথম জীবনে দরিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবে পরবর্তী জীবন সচ্ছলতায় কেটেছে তাঁর। যে ছয়জন সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবদ্দশায় ফতোয়া দানের অনুমতি পেয়ে ছিলেন হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.) তাঁদেরই একজন। রাসুল (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলতেন আবু মুসা (রা.) অশ্বারোহীদের নেতা। হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.) ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। সেখানকার আল আশয়ার গোত্রের সন্তান হওয়ায় তিনি আল আশয়ারি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আবু মুসা (রা.) ইসলামের পরিচয় পেয়ে ইয়েমেন থেকে মক্কায় আসেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হাতে বাইয়াত নেন। কিছুদিন মক্কায় অবস্থানের পর স্বদেশবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবার ইয়েমেনে ফিরে যান। আবু মুসা (রা.) ছিলেন তাঁর বংশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। তাই খান্দানের লোকেরা দ্রত এবং ব্যাপকভাবে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেন। রাসুল (সা.) এর মদিনায় হিজরতের কয়েক বছর পর প্রায় ৫০ জন মুসলিমের একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে আবু মুসা (রা.) মদিনায় যাওয়ার জন্য ইয়েমেন থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন। তাঁরা যখন মদিনায় পৌঁছান সে সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীও খাইবার বিজয় শেষ করে মদিনায় ফেরেন। রাসুল (সা.) আবু মুসা (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের সবাইকে খাইবারের গনিমতের অংশ দান করেছিলেন। আবু মুসা (রা.) তাড়াতাড়ি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত হয়ে ওঠেন।
নিজের দেশ হওয়া শুরু থেকেই ইয়েমেনের মানুষদের ওপর আবু মুসা (রা.) র যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি সুষ্ঠুভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। আরেক গভর্নর মুযয়াজ (রা.) এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। তাঁরা সীমান্তে মিলিত হয়ে নানা বিষয়ে পরামর্শ করতেন। লোকজন জড়ো করে তাঁদের সামনে তিনি ভাষণ দিতেন। পথেঘাটে কারও দেখা পেলে তাদের কাছে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণী পৌঁছে দিতেন। কেউ অজ্ঞতাপ্রসূত প্রশ্ন করলেও তিনি কোমলভাবে তাকে জবাব দিতেন। তিনি যে শুধু জ্ঞান পিপাসু ছিলেন তাইনা জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন। তিনি মনে করতেন যতটুকু তিনি জানবেন অন্যকে তা জানানো ফরজ। একবার এক ভাষণে বলেনধ যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ইলম দান করেছেন তার উচিত অন্য ভাইদের তা জানানো। তবে যে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান নেই সে সম্পর্কে একটি শব্দও মুখ থেকে বের করবে না। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সরল, উদারপ্রাণ, খোদাভীরু, পরহেযগার, সহনশীল ও কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি। আল্লাহর ভয়ে সর্বদা তিনি ক্রন্দন করতেন।
ইসলামী শিক্ষায় অবদান : একজন সৈনিক এবং রাজনীতিবিদ হিসাবে আবু মুসার খ্যাতি সত্ত্বেও তিনি তার কুরআন তেলাওয়াত করার জন্যও প্রশংসিত হয়েছিল এবং তিনি প্রথম দিকের অন্যতম সংস্করণ (মাশাহেফ) এর সাথে জডিত ছিলেন। যা পরবর্তিতে উসমানের দ্বারা বর্ধিত হয়েছিল। তিনি একজন শ্রদ্ধেয় ফকিহও ছিলেন এবং প্রথমদিকে মুসলিম ইতিহাসের শীর্ষস্থানীয় বিচারকদের মধ্যে গণ্য হতেন। লোকেরা বলত : এই উম্মতের বিচারকরা চারজন : উমর ইবনে খাত্তাব, আলী ইবনে আবী তালিব, আবু মুসা আশয়ারী এবং জায়েদ ইবনে সাবিত। আবু মুসা আশআরি অনেকগুলি হাদীস বর্ণনা করার পাশাপাশি ইসলামের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবেও পরিচিত। হজরত আবু মুসা (রা.) রাত-দিন প্রায় প্রতি মুহূর্ত কোরআন পড়তেন ও শেখাতেন। ইয়েমেনের গভর্নর থাকা অবস্থায় একবার মুয়াজ ইবনে জাবাল জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি কীভাবে কোরআন তিলাওয়াত করেন? বললেন রাতে বা দিনে যখনই সুযোগ পাই একটু তিলাওয়াত করে নিই। তাঁর সুমধুর কোরআন পাঠ রাসুল (সা.) এর খুবই পছন্দ ছিল। তাঁর কোরআন তিলাওয়াত শুনলেই রাসুল (সা.) দাঁযিয়ে যেতেন। একবার আয়েশা (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে রাসুল (সা.) কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে আবু মুসা (রা.) এর কোরআন পাঠ শুনে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ শোনার পর আবার রওনা দিলেন। তাঁর এই অসাধারণ তিলাওয়াতের কারণে রাসুল (সা.) মুয়াজ ইবনে জাবালের সঙ্গে তাঁকেও নওমুসলিমদের কোরআন শেখাতে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। কোরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদিসের খিদমতেও তাঁর অনেক অবদান ছিল। আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.) এর বর্ণনা করা হাদিসের সংখ্যা ৩৬০। তিনি অন্যের জ্ঞানেরও মর্যাদা করতেন। একবার তিনি একজনকে মিরাস (ওয়ারিশ সম্পত্তি) সংক্রান্ত একটি ফতোয়া দিলেন। লোকটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর কাছে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি আরেক রকম ফতোয়া দেন। আবু মুসা তা শুনে নিজের ভুল স্বীকার করে বলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) জীবিত থাকা পর্যন্ত তোমাদের আমার কাছে আসা উচিত নয়। খলিফা উমর (রা.) এর শাসনামলে বসরা শহর প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম গভর্নর হিসেবে তিনি আবু মুসা (রা.) কে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কুরআন শিখে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন : হজরত হাতান বিন আবদুল্লাহ; হজরত আবু রেজা ; হজরত আবু শায়খ হানায়ি প্রমুখ।
হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.) অত্যন্ত জ্ঞানী ছিলেন। হজরত আলী (রা.) বলতেন আবু মুসা মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিদ্যার রঙে রঞ্জিত। তিনি জ্ঞানীদের সাহচর্যে থাকতে এবং আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারেও তিনি নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন যে ব্যক্তিকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন তার উচিত অন্যদের তা জানানো। হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.)র গুণ ছিল অনেক। তিনি প্রথম দিকের মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় বিচারক। সবাই বলত : এই উম্মাহর বিচারক চারজন-উমর (রা.), আলী (রা.), আবু মুসা (রা.) ও জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)। আবু মুসা (রা.)-মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হজরত আবু মুসার সামনে উম্মাতের কল্যান চিন্তাটাই ছিল সবচেয়ে বড়। এজন্য সারাজীবন ব্যক্তিগত সব লাভ ও সুযোগের প্রতি পদাঘাত করেছেন। আলী (রা.) ও মুয়াবিয়ার রা: মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছে তখন একদিন মুয়াবিয়া আবু মুসাকে বলেছেন যদি তিনি মুয়াবিয়া সমর্থন করেন তাহলে তার দু ছেলেকে যথাক্রমে বসরা ও কুফার ওয়ালী নিয়োগ করবেন এবং তার সুযোগ-সুবিধার প্রতিও যত্নবান হবেন। জবাবে আবু মুসা লিখলেন: আপনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। যে জিনিস আপনি আমার সামনে পেশ করেছেন তার আমার প্রয়োজন নেই। আসলে আবু মুসা আল-আশয়ারি (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে প্রকৃতির। ধোকা ও কূটনীতি কি জিনিস তিনি জানতেন না। এ কারণে তাকে বিচারক নিযুক্ত করার ব্যাপারে হযরত আলী রা: দ্বিমত পোষন করেছিলেন। কিন্তু তার পক্ষের লোকদের চাপাচাপিতে তিনিও মেনে নেন। আমর ইবনুল আসের কুটনৈতিক জালে পরাজিত হয়ে আবু মুসা অনুশোচনায় এত দগ্ধিভূত হলেন যে সেই মুহুর্তে তিনি মক্কার পথ ধরলেন। জীবনে আর কোন ব্যাপারে তিনি অংশগ্রহন করেননি।
খলিফা উমর (রা.) তাঁকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করার পর আবু মুসা (রা.) সেখানে গিয়ে সমবেত জনতার সামনে দেওয়া এক ভাষণে বলেন আমিরুল মোমেনিন আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে রবের কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত শিক্ষা দেব। আর আপনাদের কল্যাণের জন্য রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখব। বসরাবাসীর পানির কষ্ট ছিল। আবু মুসা (রা.) দজলা নদী থেকে খাল কেটে বসরা শহর পর্যন্ত তার পানি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ১০ মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করে বসরাবাসীর পানির কষ্ট দূর করা হয়। ইতিহাসে সেই খাল ‘নহরে আবি মুসা’ নামে প্রসিদ্ধ। হিজরি ২৯ সাল পর্যন্ত তিনি বসরার গভর্নর ছিলেন। মক্কায় হিজরি ৪৪ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজরত আবু মুসা আশআরির মতো কুরআনের সেবক ও খাদেম হিসেবে কবুল করুন। তাদের হৃদয়ে কুরআনের অনুরাগ, প্রেম ও মহব্বত পয়দা করে দিন। আমিন।
লেখক: ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
Leave a Reply